আর্থ্রাইটিস কি? আর্থ্রাইটিস কেন হয় ও আর্থ্রাইটিস এর ঘরোয়া চিকিৎসা।

আর্থ্রাইটিস কি? আর্থ্রাইটিস কেন হয়? আর্থ্রাইটিস এর ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে এই পোস্টটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। আর্থ্রাইটিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আশা করি উপকারে আসবে।

পোস্ট সূচিপত্র:

আর্থ্রাইটিস কি?

আর্থ্রাইটিস (Arthritis) হলো একটি রোগের নাম। Arthritis দুটি গ্রিক শব্দ arthro ও itis থেকে এসেছে। arthro শব্দটির বাংলা অর্থ হলো সন্ধি এবং itis শব্দটির বাংলা অর্থ হলো প্রদাহ। আর্থ্রাইটিস (Arthritis) শব্দটির বাংলা অর্থ হলো সন্ধি প্রদাহ।
আর্থ্রাইটিস কে আমরা সাধারণত জয়েন্ট পেইন বা এক ধরনের বাত হিসেবেই জানি। আর্থ্রাইটিসকে অনেকে আবার জয়েন্ট বাত বলে থাকে। আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্ট পেইন হলে শরীরের অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে ব্যথার পাশাপাশি আরও কিছু উপসর্গ দেখা দেয়।

সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি হলেও যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরা পর্যন্ত আর্থ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

আর্থ্রাইটিস এর প্রকারভেদ

আর্থ্রাইটিস ব্যাপক অর্থবহ ও বিস্তৃত একটি শব্দ। এটি শুধু একটি রোগ নয়। আর্থ্রাইটিস বলতে একই ধরনের অনেকগুলো রোগকে বোঝায়। প্রায় ১০০ টির বেশি একই ধরনের রোগ নিয়ে হয় এই আর্থ্রাইটিস। বিভিন্ন ধরনের আর্থ্রাইটিস রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত আর্থ্রাইটিস হলো-
  • অস্টিওআর্থ্রাইটিস
  • অ্যানকিলোজিং স্পন্ডিলাইটিস
  • জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস
  • গউট বা গেঁটেবাত
  • সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস
  • রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগী গুলোর মধ্যে অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এই দুই ধরনের আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি।

আর্থ্রাইটিস কেন হয়?

আর্থ্রাইটিসের ধরন যেমন ভিন্ন তেমনি এর কারণও ভিন্ন। অর্থাৎ সব ধরনের আর্থ্রাইটিস একই কারণে হয় না। যেমনঃ‌ শরীরে অত্যাধিক পরিমাণে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে গাউট হয়। অটোইমিউন রোগের কারণে আর্থ্রাইটিস হতে পারে। অটোইমিউন রোগ হল এক ধরনের রোগ যেখানে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে আমাদের শরীরকেই আক্রমণ করে ফেলে। এই রোগের কারণে জয়েন্টে বা অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ হয় যা পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস সাধারণত আমাদের হাড়ের জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধির অতিরিক্ত ব্যবহার করার ফলে হতে পারে। অতিরিক্ত মোটা স্বাস্থ্য আর্থ্রাইটিসের একটি কারণ। ধুমপান বা তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ফলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। যাইহোক‌ আর্থ্রাইটিসের অনেক কারণ এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট।

আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ ও উপসর্গ

আর্থ্রাইটিসের ধরন ভিন্ন হলেও এদের কিছু সাধারন উপসর্গ রয়েছে। যেমনঃ আক্রান্ত স্থান ফুলে যায়,ব্যথা হয়,আক্রান্ত স্থান শক্ত হয়ে যায়। আর্থ্রাইটিসের অন্যান্য লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে রয়েছেঃ
  • আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে যায়
  • আক্রান্ত স্থানে ফোলা ভাব থাকে
  • ব্যথা ও অস্বস্তির কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে
  • আক্রান্ত হাড়ের জোড়া বা অস্থিসন্ধি উষ্ণ থাকে
  • হাঁটা চলার অক্ষমতা
  • শরীরের ওজন কমে যেতে পারে
  • পেশীতে ব্যথা ও দুর্বলতা

আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি কাদের বেশি?

কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কারণগুলো আমাদের জানা দরকার। আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ

বয়সঃ বয়সের সাথে আর্থ্রাইটিসের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

লাইফস্টাইলঃ ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য সেবন ও ব্যায়ামের অভাবে আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

লিঙ্গঃ পুরুষের চাইতে মহিলাদের আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
অতিরিক্ত শারীরিক ওজনঃ দেহের ওজন অতিরিক্ত বেশি হলে কোমর ও পায়ের জয়েন্ট গুলোতে বেশি চাপ পড়ে। ফলে আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

হাড়ের জয়েন্টে আঘাতঃ যদি অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জয়েন্টে আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে পরবর্তীতে আর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসার (Treatment of rheumatoid arthritis) জন্য অবশ্যই একজন রিউম্যাটোলজিস্ট দেখাতে হবে। অন্যসব আর্থ্রাইটিস রোগের ক্ষেত্রে একজন অর্থোপেডিক এর পরামর্শ নেয়া উচিত। অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করে। এতে সাময়িকভাবে ব্যথা কমে ঠিকই কিন্তু আর্থ্রাইটিস আরো জটিল হয়ে ওঠে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন করা উচিত না।
দীর্ঘদিন পেইন কিলার খেলে শরীরে দেখা দেয় নানা জটিল সমস্যা। আবার পেইন কিলারের রয়েছে নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। তাই আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় পেইন কিলারের ব্যবহার সীমিত করে লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে। তার জন্য আর্থ্রাইটিস বা বাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়েই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি বেশ সহায়ক। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট নির্দেশিত ব্যায়াম আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ গুলো কমাতে সাহায্য করবে পাশাপাশি অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জয়েন্টের পার্শ্ববর্তী পেশিগুলোকে মজবুত করবে।

আর্থ্রাইটিসের ঘরোয়া প্রতিকার

লাইফস্টাইল বা জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব। তাছাড়া কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে যেগুলো আর্থ্রাইটিসের উপসর্গগুলো কমাতে সাহায্য করে। যেমনঃ

১. শরীরের ওজন হ্রাস

অতিরিক্ত শারীরিক ওজন আর্থ্রাইটিসের একটি কারণ। শরীরের ওজন অতিরিক্ত বেশি হলে কোমর ও পায়ের অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জয়েন্টগুলোতে চাপ পড়ে ফলে অস্থিসন্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কথায় বললে, অতিরিক্ত শারীরিক ওজন আর্থ্রাইটিসের সার্বিক অবস্থাকে অবনতি করে। তাই আপনি যদি মোটা স্বাস্থ্যের অধিকারী হন তাহলে আপনার শরীরের ওজন কমাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

২. নিয়মিত ব্যায়াম

নিয়মিত ব্যায়াম আর্থ্রাইটিসের উপসর্গগুলো কমায়। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট আর্থ্রাইটিসের ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গগুলো কমাতে ব্যায়ামের সুপারিশ করেন।
তাছাড়া নিয়মিত হাঁটা-চলা, সাইকেলিং, তাই-চি, সাঁতার কাটা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

৩. খাদ্য

গাউট এক ধরনের আর্থ্রাইটিস বা বাত। শরীরে ইউরিক এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে এই বাত হয়। গাউট প্রতিরোধে পিউরিন যুক্ত খাবার গুলো অল্প পরিমানে খেতে হবে।

কিছু খাদ্য রয়েছে যেগুলো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ বৃদ্ধি করে। যেমনঃ লাল মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, স্যাচুরেট ফ্যাট এবং চিনি ও লবণযুক্ত খাবার আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়ায়। তাই এই ধরনের খাদ্যগুলো খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।
তাছাড়া এই জাতীয় খাবার উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, দেহের ওজন বৃদ্ধি, কোলেস্টেরল বৃদ্ধি সহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে পুষ্টিকর ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

তাজা ফলমূল ও শাকসবজি বহু পুষ্টিগুণ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidants) শরীর থেকে ফ্রি রেডিক্যাল দূর করে শরীরের কোষকে রক্ষা করে প্রদাহ কমায়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই অস্বাস্থ্যকর খাদ্য বাদ দিতে হবে এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।

৪. হলুদ

হলুদ আমাদের কাছে একটি মসলা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। কিন্তু হলুদের নানা গুণ আমাদের অনেকের কাছে অপরিচিত। হলুদের রয়েছে কারকিউমিন নামক এক ধরনের উপাদান। যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। হলুদের এই অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি(Anti-inflammatory) বৈশিষ্ট্যের জন্য এটি অস্টিও আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অন্যান্য বাতের ব্যথা ও প্রদাহ উপশমে সাহায্য করে।

৫. হিট ও কোল্ড থেরাপি

গরম ও ঠান্ডা থেরাপি দ্রুত আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা কমায়। গরম বা হিট থেরাপিকে থার্মোথেরাপিও বলা হয়। আক্রান্ত স্থানে তাপ প্রয়োগ করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন ইলেকট্রিক্যাল হিটিং প্যাড, আর্দ্র হিটিং প্যাড, গরম পানির বোতল ইত্যাদি। কিন্তু ব্যথাযুক্ত স্থানে ফোলা বা ক্ষত থাকলে হিট থেরাপি বা থার্মোথেরাপি প্রয়োগ করা যাবে না।
কোল্ড থেরাপি বা ঠান্ডা থেরাপিকে ক্রায়োথেরাপিও বলা হয়। জয়েন্টের ব্যথা ও ফোলা ভাব কমাতে ঠান্ডা থেরাপি‌ একটি সহজ ও কার্যকর উপায়। একটি তোয়ালে অথবা কাপড়ে কয়েক টুকরা বরফ মুড়ে নিয়ে ব্যথাযুক্ত স্থানে প্রয়োগ করলে ব্যথা দ্রুত উপশম হবে। তবে ব্যথাযুক্ত থানে সরাসরি বরফ লাগানো যাবে না। এতে‌ বিপরীত হতে পারে।

শেষ কথাঃ

এই আর্টিকেলটিতে মূলত জানানো হয়েছে আর্থ্রাইটিস কি? আর্থ্রাইটিস কেন হয় এবং আর্থ্রাইটিস এর ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে (What is arthritis? About Arthritis Causes and Arthritis Home Remedies). দীর্ঘদিন আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকেই মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাছাড়া পেইন কিলার গুলোর রয়েছে নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

তাই পেইন কিলারের ব্যবহার কমাতে হবে। পাশাপাশি লাইফ স্টাইলের পরিবর্তন ও ভেষজ ওষুধের ব্যবহার হতে পারে আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসার একটা অংশ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

জরিপ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url